ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪
অটিজম

অটিস্টিক শিশুটিকে কথা বলা শেখাবো কিভাবে?

অটিস্টিক শিশুটিকে কথা বলা শেখাবো কিভাবে?

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অটিস্টিক শিশুর বাবামা'দের উদ্বেগের একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে, তাদের সন্তানটি কথা বলছেনা। তাদের একটাই জিজ্ঞাসা, তাদের সন্তান কথা বলবে কবে বা কি করলে কথা বলবে! এটি অনেক অটিস্টিক শিশুর বাবা মা এর একটি কমন প্রশ্ন। এ প্রশ্নটি নেহায়েত সাধারণ কোন জিজ্ঞাসা নয়, এর আড়ালে অনেক আক্ষেপ, দীর্ঘশ্বাস এবং নির্ঘুম রাতের কান্না লুকিয়ে থাকে। এটির জবাব সত্যি সত্যিই দেয়া কঠিন। কারণ আমরা সবাই জানি প্রতিটি অটিস্টিক শিশুই আলাদা আলাদা সক্ষমতার অধিকারী এবং প্রত্যেকের আগ্রহের বিষয়ও স্বতন্ত্র। তাদের স্বভাব এবং বৈশিষ্টের ভিন্নতার জন্য কিভাবে তাকে কথা বলা শেখাবেন তার কোন “one fix-suits all” ধরণের সমাধান নেই। তবে এক একজন শিশুর সক্ষমতা এবং আগ্রহকে বিবেচনায় এনে এ ব্যাপারে কিছু পরীক্ষিত সমাধান রয়েছে- সেগুলোর যে কোনটির বা একাধিক মডেল এর মিশ্রনে চেস্টা করে দেখা যেতে পারে। এ ব্যাপারগুলোতে বাবামায়ের পাশাপাশি শিশুটির থেরাপিস্ট বা কেয়ারগিভারগন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেন। শিশুটির পছন্দ অপছন্দ মিলিয়ে তার কিসে আগ্রহ বা কিসে অনাগ্রহ, এসব বিষয়ে সঠিক চিত্রটি বাবা মায়েরাই দিতে পারেন। এ বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ বা থেরাপিস্টগন আপনার জন্য একটি সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করবেন, যেটি শিশুটির উপর প্রয়োগ করা হয়।

যখন আপনি নিজে বসে ভাবছেন যে কিভাবে আপনি আপনার শিশুটিকে কথা বলা শেখাবেন- তখন আপনি আপনার শিশুটির দিক থেকে ভেবে দেখুন; সে যদি ভেবে থাকে যে “আমি কেন কথা বলব? আপনি আপনার শিশুর দিকে ভাল করে লক্ষ্য করুন। আপনি লক্ষ্য করবেন যে, একটি শিশু চারপাশের কারো সাথে ইন্টারেকশন এভয়েড করার জন্য নিজে নিজে বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত থাকছে, একই সাথে সে তার চারপাশের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের চেস্টা করছে যাতে সব তার অনুকূলে থাকে। এজন্যে সে হয়তো চিৎকার করছে বা নিজেকে আঘাত করছে বা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে- এবং এসব করে সে তার চাহিদাকৃত ইচ্ছাগুলোকে পূরণ করছে এবং চারপাশের সবাই তার দিকেই মনযোগী হয়ে আছে, সেটি নিশ্চিত করছে। প্রশ্ন আসতে পারে যে শিশুটি অমন করছে কেন? আমরা এসব ক্ষেত্রে নিজেরাই অনেক জবাব দিয়ে দেই। যেমনঃ

১। শিশুটি অটিস্টিক।

২। শিশুটি কথা বলতে পারেনা।

৩। তার সকল সেন্স বা অনুভূতি অন্য কোন কিছু নিয়ে ব্যাস্ত।

৪। সে নিজের মত করে থাকতে চায়, নিজস্ব পরিমন্ডলের কোন পরিবর্তন গ্রহন করেনা।

৫। তার নিউরোলোজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট ঠিকমত হয়নি। অথবা

৬। সে তার নিজের আচরণ বা অভ্যাসকে নিজের মত করে নিয়েছে এবং স্বীয় আচরণবোধের বলয় থেকে বেরোতে চায়না।

বাস্তবতা হচ্ছে যে আমরা সুনির্দিস্টভাবে কি কারণে এটি হচ্ছে তা জানিনা। এটি উপরের যে কোন একটি কারণ বা একাধিক কারণের জন্যে এমন হচ্ছে। এ প্রসংগে নিউরোডাক্তারগন বা তার থেরাপিস্ট শিশুটির আচরণ বিবেচনায় কথা বলার কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ধারণ করে দিতে পারেন। প্রাথমিকভাবে বাবা মা হিসেবে আপনি তার সাথে আচরনে এমন একটি এপ্রোচ তৈরি করুন যাতে শিশুটি তার চারপাশের পরিবেশের প্রতি মনোযোগী হয়। যেহেতু অটিস্টিক শিশুরা খুব সীমিত বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়, তাই তার প্রতি যে এপ্রোচ আপনি ফলো করবেন সেটি যেন তার আগ্রহের বা কৌতূহলের বিষয়কেন্দ্রিক হয়। আমরা সবাই জানি যে, অটিস্টিক শিশুদের সাথে ইন্টারেকশন একটি কঠিন তথা কস্টসাধ্য বিষয়। আগেই বলেছি যে তার পছন্দের জিনিষ দিয়ে শুরু করুন। যতো বেশী তার সাথে ইন্টারেকশনের চেস্টা করবেন- মনে রাখবেন ততই পদ্ধতীটি আপনার কাছে সহজ হয়ে আসবে। যে সব আচরণ বা খেলনা বা বস্তু তাকে আকর্ষণ করে সেগুলো দিয়েই আপনাকে চেস্টা করতে হবে। এধরণের আচরণ বা বস্তু বা খেলনা সমূহ কি কি ধরণের হতে পারে- তার একটা সাধারণ ধারণা নেয়া যাকঃ

১। তার যে কোন পছন্দনীয় সুনির্দিস্ট খেলনা

২। আধো আধো বোলে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ করা

৩। সুড়সুড়ি দেয়া বা তাকে hug করা

৪। টিভি রিমোট

৫। কোন নির্দিস্ট ভিডিও

৬। কোন নির্দিস্ট খাবার

৭। কোন নির্দিস্ট পানীয় বা

৮। কোন খেলনা যেটিতে কোন মিউজিক হয় বা কোন শব্দ করে।

এবার আপনাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে তার এ পছন্দনীয় বস্তু বা খেলনা বা বিষয়টির নিয়ন্ত্রণ নেয়া। শুরুতে এটি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ হবে। কারণ শিশুটিকে তার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাহিরে আপনি নিয়ে আনতে চাইছেন। তার পছন্দের বিষয় বা বস্তু বা খেলনা নিয়ে আপনি যেভাবে তার সাথে কমিউনিকেট করার চেস্টা করবেন তা যেন স্পেসিফিক হয়, সে যেন বোঝে যে আপনি কি চাচ্ছেন বা তাকে কি করতে বলছেন। তার সাথে তার প্রীয় ওই বস্তু বা খেলনা বা বিষয় নিয়ে তার সাথে এমন কিছু খেলা বের করুন যাতে সেও অংশগ্রহন করে। আপনাকে আপনার শিশুর সামর্থ এবং সাধ্য অনুযায়ী নিজে নিজে পদ্ধতী বের করতে হবে। লক্ষ্য করুন আপনি তার ঐ খেলনা বা বস্তু নিয়ে কি করলে সে আপনার দিকে তাকায় বা আপনি তার ঐ জিনিষ নিয়ে কিছু করলে সেও আপনাকে অনুসরণ করছে কিনা। অনেক অটিস্টিক শিশু ভিজ্যুয়াল লার্নার। তাদের মনযোগের অভাব বা কোন কোন সময়ে শ্রবণশক্তির সীমাবদ্ধতার জন্যে তারা তাদেরকে কিছু বললে সেটি তারা অনুকরণ করতে পারেনা বা করেনা।

এজন্যে অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রে ভিজ্যুয়াল এপ্রোচ সাধারণত বেশী উপযোগী। এক্ষেত্রেও আপনাকে আপনার শিশুর পছন্দ অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে হবে। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ছবি দিয়ে বা দৃশ্য দেখিয়ে তাকে ভার্বাল কমিউনিকেশনের প্রতি উৎসাহ তৈরি করাতে পারেন। ছোট ছোট কার্ডে ছবি প্রিন্ট করে সেগুলোকে ল্যামিনেট করে সেগুলো দিয়ে আপনি এটি করতে পারেন। ছবি প্রিন্ট করার সময় আপনাকে স্পেসিফিক হতে হবে। আমি ব্যাক্তিগতভাবে এ পদ্ধতিতে আমার শিশুর ক্ষেত্রে উপকৃত হয়েছি। আমি প্লেয়িং কার্ড বা তাস এর আকারের ৫টি কাগজে ১, ২, ৩, ৪ এবং ৫ বড় বড় করে প্রিন্ট করিয়েছি। (প্রতি কার্ডে শুধু একটি করে সংখ্যা)। এরপর কার্ডগুলো পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে রেখে প্রতিটার উপর একটি আংগুল রেখে রেখে ১, ২, ৩, ৪, ৫ বলেছি। যখন যে কার্ডে আংগুল রাখি, তখন সেটিই উচ্চারন করি। প্রথমে আমার অটিস্টিক মেয়ে এতে সাড়া দিচ্ছিল না। আমি যখনই দেখি যে সে একটু শান্ত হয়ে বসে আছে, তখনই তার সামনে কার্ডগুলো বিছিয়ে ১,২, ৩, ৪, ৫ বলে যাচ্ছি। এভাবে ২/৩ দিন পর আমি লক্ষ্য করলাম যে আমার আংগুলের সাথে সাথে তার দৃস্টিও পরের কার্ডের দিকে যাচ্ছে। এতে আমি বুঝলাম যে সে এতে আগ্রহ নিচ্ছে। তখন আমি আরো কয়েকবার এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত বলে তারপর তার উপর পরীক্ষাটি চালালাম।

পরীক্ষাটি ছিল আমি আংগুল দিয়ে কার্ড স্পর্শ করে করে এক, দুই, তিন বলে পরের কার্ড যাতে চার লেখা আছে সেখানে আংগুল রেখে চুপ করে থাকলাম। তখন আমার মেয়ে কিছুক্ষন সে কার্ড এর দিকে তাকিয়ে থেকে আধো স্বরে বলল, “চার”। এটি ছিল আমার এবং আমার মেয়ে- দুজনের জন্যে এক বিরাট সাফল্য। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় পরে তাকে ইংরেজী বর্ণমালার বই এ বর্নের উপর স্পর্শ করে করে তাকে সকল বর্ণমালা শেখানো হয়েছে এবং সে এখন নিজে নিজে ইংরেজী পড়তে পারে।

এ কারণেই বলেছি যে, ভিজ্যুয়াল পদ্ধতি অটিস্টিক শিশুদের ক্ষেত্রে খুবই উপযোগী একটি পদ্ধতী। আমি বলছিনা যে, এ পদ্ধতিটি সবার ক্ষেত্রে কাজ করবে। এটি আমার সন্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে।। আপনিও ক্রিয়েটিভ কিছু পদ্ধতি বের করার চেস্টা করুন। আপনার সন্তানের সামর্থ বা সাধ্য অনুযায়ী এ চেস্টাগুলো করুন। এক দিনেই তাকে বেশী চাপ দেবেন না। এতে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি এবং সে পরে আপনার সাথে বসতে নাও চাইতে পারে। তাকে একঘেয়েমির ভেতর রেখেও এসব চেস্টা করা ঠিক নয়। তাকে শেখানোর সময়গুলো যেন তার জন্য আনন্দময় হয়। কি ধরণের খেলা সে পছন্দ করবে, বা আপনার কোন ধরণের আচরণে সে আনন্দিত হবে, তা ভেবে বের করুন। তার ডাক্তার বা থেরাপিস্ট বা বিশেষ স্কুলের শিক্ষক, তাদের সাথে কথা বলুন। এ বিষয়গুলোতে এরাই আপনার সন্তানকে সঠিক সহায়তা দিতে পারবেন।

উপরে