ভাষা আন্দোলনে পুরান ঢাকার মানুষ বিশেষ করে পুরান ঢাকাকে একসময় যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন সেই ঢাকাই সর্দারদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মুখের ভাষাকে হরণ করে তার বিপরীতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে তৎকালীন সরকার ও তার কুশীলবরা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারা মারমুখী হয়ে রুখে দাঁড়ায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে জীবনবাজি রাখে । ছাত্রসমাজের এই প্রতিবাদী ভূমিকা সে সময়কার সরকার খুব একটা ভালোভাবে নিতে পারেনি। তারা নানাভাবে এই আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছাত্রসমাজকে দমিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল।
ঢাকাবাসীদের সাথে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আগে থেকেই পুরান ঢাকার অবস্থাপন্ন বাসাবাড়িতে মেধাবী ছাত্রদের লজিং থাকার একটা ট্রাডিশন চালু ছিল। ঢাকাবাসীর দুটো ধারণা এর পেছনে কাজ করত। এতে করে পড়াশোনায় অনগ্রসর নিজেদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারটি নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি লজিং থাকা ছাত্রদেরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ আর্থিকভাবে তারা লাভবান হতে পারবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী ছাত্র তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় লজিং থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেত এবং মাস শেষে কিছু টাকা দেশের বাড়িতেও পাঠাতে পারত বয়সে তরুণ থাকা সত্ত্বেও লজিং থাকা এই ছাত্রদের পুরান ঢাকার সব বয়সী মানুষের কাছে এরা খুব আদব-কায়দা পেতো। তাদেরকে যথেষ্ট সম্মান জানাতেও কসুর করত না তারা। ঢাকার মানুষ শিক্ষকের সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করত না।
লজিং-শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্র কখনো বেয়াদবি করেছে এমন অভিযোগ বাড়ির মুরব্বির কাছে গেলে মুরব্বি ঢাকাইয়া রসবোধে স্বভাবসুলভ ভাষায় কড়া নির্দেশ দিতেন শিক্ষকদের, ছার, আমার পোলা হালায় যদি আপনের লগে কোনো রহমের বগি-চগি (মানে উল্টাপাল্টা) আর বেদ্দবি (বেয়াদবি) করে তাইলে হালারে পিটায়া ওর পিঠের চামড়া দিয়া চপ্পল বানাইবেন, হেরপর হেই চপ্পল পায়ে পিন্দা আপনে ইনভারসিটি যাইবেন। মাগার বেদ্দবি সহ্য করন যাইব না। শিক্ষক হইল গিয়া বাপের মতো আর হেরে করবো অসম্মান! ‘কাভি নেহি-কাভি নেহি’ এরকম একটা মিথ তখন ঢাকাবাসীর মধ্যে চালু ছিল।
লজিং থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা আলাদা সম্মান আর শ্রদ্ধার জায়গা তোলা ছিল ঢাকাবাসীর হৃদয়ে । তারা মনে করত এসব মেধাবী ছাত্ররা বাবা-মাকে বিদেশে (দূরের জেলা শহরকে তখন গণ্য করা হতো বিদেশ হিসেবেই) ফেলে রেখে কষ্ট করে পড়ালেখা করতে শহরে এসেছে। পড়াশোনা শেষে তারা যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তবে তাদের বাবা-মায়ের স্বপ্ন সার্থক হবে। পুরান ঢাকার দিল দরিয়া মানুষজন দূর জেলা শহরের সেই সব বাবা- মায়ের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা, মানবিকতা, দায়িত্ব এভাবেই পালন করত।
পুরান ঢাকার মানুষের মধ্যে এই মানবিক ব্যাপারটি ভীষণভাবে কাজ করত। এরই ধারাবাহিকতায় বাবা-মা ছেড়ে শহরে পড়তে আসা মেধাবী ছাত্রদের লজিং রেখে তারা মনে করত তারাও নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুত্র-সম ছাত্রদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি উঠলে ঢাকাবাসীদের একটি বড় অংশ প্রথম দিকে ছিল নির্বিকার। তাদের কেউ কেউ নেয় সহিংস অবস্থানও। ১৯৪৭ সালের শেষে দেশব্যাপী ভাষার প্রশ্নে বিক্ষোভ শুরু হলে পুরান ঢাকার উর্দুভাষীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী আবাস আক্রমণ করে। চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া।
তখন ছাত্রনেতারা পুরান ঢাকার সর্দারদের সঙ্গে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন। সর্দারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের সহ-সভাপতি গোলাম মাওলা দায়িত্ব দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র শরফুদ্দীন আহমদ (যিনি নিজেই ছিলেন ঢাকাইয়া) মঞ্জুর হোসেন ও আলীম চৌধুরীকে (একাত্তরে শহীদ)।
সর্দারের প্রধান ছিলেন কাদের। ছাত্র প্রতিনিধিরা তাকে বোঝাতে চাইলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হলে সারাদেশের মানুষ ভবিষ্যতে বেকার হয়ে যাবে। সর্দার বোঝেন না। মনও গলে না। উল্টো তিনি বলেন, উর্দুটাই ভালো। আরবির লাহান দেখা যায়। মন খারাপ করে বসে থাকেন তিন ছাত্র। যথারীতি বৈঠকে আসে চা-নিমকি, শিঙ্গাড়া ও মিষ্টি। জিভে জল আসার মতো ব্যাপার। কিন্তু সামনে খাবার দেখেই শরফুদ্দীন আহমদের মাথায় এক বুদ্ধি খেলে। তিনি ওঠার ভান করে বলেন সর্দার সাহেব, আপনি যখন কথা দিচ্ছেন না, তো আমরা চলি। এ অবস্থায় আমাদের পক্ষে চা-নাশতা গ্রহণ করা সম্ভব না। অতিথিরা না খেয়ে চলে যাবেন, এ তো ঘটতে দেয়া যায় না।
অগত্যা সর্দার ছাত্রদের ডেকে বসালেন এবং কথা দিলেন, এবার পুরান ঢাকার মুসলমানরা ছাত্রদের বিরোধিতা করবে না। তবে আন্দোলনে যোগ দেবে এমন কথাও তিনি দেননি। বৈঠকে কাদের সর্দার দুজন লোককে ডেকে বলে দিলেন, ভাষার প্রশ্নে বিরোধিতা না করার বিষয়টি অন্য সর্দারদেরও যেন জানিয়ে দেয়া হয়। ছাত্ররা খুশি মনে ফিরে আসেন।
এভাবেই যেখানে ছিল বিরোধিতা, সেখানে দেখা গেল সহযোগিতা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়- একুশের আন্দোলনে ঢাকাইয়া সর্দারদের অধিকাংশই সক্রিয় সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। যেমন নারিন্দার মাওলা সর্দার, হোসেনি দালান এলাকার পিয়ারু সর্দার, রায়সাহেব বাজার এলাকার ইলিয়াস সর্দার থেকে শুরু করে মতি সর্দারের মতো অনেকে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় সহযোগিতা করেন।
পিয়ারু সর্দার ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কাজের ব্যবহৃত সিমেন্ট জোগাড় করে দেন। এক কথায় তিনি গুদামের চাবি মেডিকেলের ছাত্র আলী আছগরের হাতে তুলে দেন।
অভিন্ন ভাবনা থেকেই যে পুরান ঢাকার অধিবাসীদের সবাই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, এমন নয়। কেউ কেউ সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে। মিছিলে গুলি চলার পর অনেকে আবেগ থেকেও বিক্ষোভে যোগ দেয়।
বেচারাম দেউড়ির গোলাম মুর্তজা করতেন বাম রাজনীতি। একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশে তিনি হাজির হয়েছিলেন। সভাশেষে রাজপথে, রাজপথ থেকে তার ঠাঁই হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। গোপীবাগের তরুণ আব্দুর রহিমও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেন আন্দোলনে। কলতাবাজারের ছেরাজুদ্দিন নান্না মিয়া মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে। পুরান ঢাকার অনেক নারী ও ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে জড়ো হয়েছিল জেলখানার আশপাশে।
সূত্র:
যায় যায় দিন, ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪।
ঢাকা টাইমস, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।