ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪
"ঢাকাইয়া ভানু"

সেই ভানু "ঢাকাইয়া ভানু"

| আপডেট : ১ নভেম্বর, ২০১৭ ০৯:০৬
সেই ভানু

তাঁর আসল নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ওই নামে তাঁকে পরিবারের সদস্যরা ছাড়া কেউই চিনতেন না বৈকি। বা এখনও চিনবেন না কেউ। কিন্তু যদি বলা হয়, তিনি আর কেউ নন “ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়” আরও পরিষ্কার করে বললে “ঢাকাইয়া ভানু” বা “পূবের ভানু” তবে আর কথা নেই।

বাংলা চলচ্চিত্রের বরেণ্য এই অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধায়ের জন্মদিন ২৬ আগস্ট। ১৯২০ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন বিক্রমপুর বর্তমানের মুন্সিগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

তার বাবা ছিলেন জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মা সুনীতি বন্দ্যোপাধ্যায়। ভানুবাবুর প্রাথমিক শিক্ষা পোগোস বিদ্যালয়ে, পরের ধাপগুলিতে জর্জস হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছোটবেলা থেকেই কৌতুক ছিল তার অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। আর সে কারণেই বাংলা মঞ্চ-চলচ্চিত্র-শ্রুতিনাট্যে হাস্যকৌতুকের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিতে পেরেছিলেন তিনি। অভিনয় জীবনে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু কৌতুকশিল্পী ছিলেন এমন নয়, ‘সিরিয়াস’ অভিনয়েও তিনি ছিলেন অনবদ্য।

দেশপ্রেমী বাবা জিতেন্দ্রনাথ ছিলেন ঢাকার নবাব এস্টেটের সদর মোক্তার ও মা সুনীতিদেবী ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা দফতরে কাজ করতেন। বাবা-মা সরকারি কর্মচারী ছিলেন বলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ নিষেধ ছিল বাড়িতে। তা সত্ত্বেও ১২ বছরের ভানু লুকিয়ে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পরে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আইএ পাশ করার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ পড়েন তিনি। বুদ্ধিমান এই ছাত্রটিকে সব অধ্যাপক ভালোবাসতেন। মোহিতলাল মজুমদার, ড. শহীদুল্লাহ ও আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। নিজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেশিরভাগ সময়ে ভানুবাবু সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ক্লাসে গিয়ে পড়া শুনতেন।

১৯৪০ সালে যখন বেশিরভাগ অনুশীলন সঙ্ঘের বিপ্লবী আরএসপি নামে বামপন্থী দল গঠন করলো, তখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন। তিরিশের দশকের শেষের দিকে ছাত্রনেতা ভানু আন্দামান থেকে রাজনৈতিক বন্দিদের ফিরিয়ে আনা এবং তাদের মুক্তি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেন। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সহচর ও স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত থাকায় রাজরোষে পড়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হলেন ভানু। বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়া আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। দীনেশ গুপ্ত ছাড়াও তিনি বিনয় বসু, কেদারেশ্বর সেনগুপ্ত, রমেশ আচার্যের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৬-এ বিপ্লবী অনন্ত সিংহের সান্নিধ্যে এসে তার আদর্শ ও চিন্তাধারায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৪০ সালে বড় দিদির কলকাতার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাকাপাকিভাবে সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়, তবে তখনই “ভানু” হননি তিনি। টালিগঞ্জের অভিনেতাদের খাতায় নাম লেখানোর পর তিনি পরিচিতি পান এ নামে। ১৯৪৭ সালে “জাগরণ” ছবির মধ্য দিয়ে তাঁর বাংলা চলচ্চিত্রের জীবন শুরু হয়, সেই সঙ্গে নামও পাল্টে গিয়ে হয়ে যান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। চিৎপুরের যাত্রার মঞ্চেও ছিল ভানুর সমান আধিপত্য। শুধু অভিনয় নয়, সংলাপ লেখা এবং গানও গেয়েছেন অনেক। ভানুর কৌতুকের অডিও অতীতের মতো আজও রেকর্ড সংখ্যক বিক্রি হয়।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কলকাতায় কাটালেও নিজেকে ঢাকার ‘পোলা’ হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি গর্ব বোধ করতেন।

সুত্র: ডেইলি স্টার, ২৫ আগস্ট ২০১৭।
'আজ্ঞে আমি ঢাকার ভানু', মৃণাল দেবনাথ এর লেখা প্রবন্ধ; amadermanchitra.com.bd তে প্রকাশিত।

উপরে